সাংবাদিক আইন ও নীতিমালা
১. ভূমিকা: সাংবাদিকতার সাথে আইনের সম্পর্ক; নীতিমালার গুরুত্ব গণতান্ত্রিক সমাজে
সাংবাদিকতা হলো একটি সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে জনমত গঠন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে তোলে। এই গুরুত্বপূর্ণ পেশায়, আইন ও নীতিমালা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। আইন যেখানে সাংবাদিকতার সীমানা নির্ধারণ করে এবং সুরক্ষামূলক কাঠামো প্রদান করে, সেখানে নীতিমালা পেশাগত মানদণ্ড, নৈতিক আচরণবিধি এবং জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধতাকে সমুন্নত রাখে।
সাংবাদিকতা চর্চার স্বাধীনতা অত্যন্ত মূল্যবান, তবে এই স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। রাষ্ট্রের আইন, যেমন - মানহানি আইন, তথ্য অধিকার আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সম্প্রচার নীতিমালা, এই স্বাধীনতার একটি কাঠামো তৈরি করে। একজন সাংবাদিককে তার কাজের মাধ্যমে যেন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়, বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। অন্যদিকে, নৈতিক নীতিমালাগুলো সাংবাদিকদের স্ব-নিয়ন্ত্রিত আচরণবিধি হিসেবে কাজ করে। সত্যবাদিতা, নিরপেক্ষতা, গোপনীয়তা রক্ষা, এবং জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া – এই নীতিগুলো গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ও জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য অপরিহার্য। একটি সুস্থ ও সচেতন গণতন্ত্রের জন্য, আইন দ্বারা সুরক্ষিত এবং নৈতিকভাবে পরিচালিত সাংবাদিকতার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
২. সাংবাদিক আইন ও নৈতিকতা
সাংবাদিকের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভ হলেও, এর কিছু সীমাবদ্ধতা এবং সুনির্দিষ্ট নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা পেশাদারিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ক. সাংবাদিকের স্বাধীনতা ও তার সীমাবদ্ধতা
- সাংবাদিকতার স্বাধীনতা: স্বাধীন সাংবাদিকতা সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত মত প্রকাশের স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি সংবাদমাধ্যমকে সরকার, ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী বা অন্য কোনো পক্ষের চাপ থেকে মুক্ত থেকে সত্য তথ্য পরিবেশনের সুযোগ দেয়। এর মাধ্যমে সংবাদমাধ্যম সমাজের প্রহরী হিসেবে কাজ করে এবং ক্ষমতার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।
- সীমাবদ্ধতা: তবে এই স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। কিছু আইনি ও নৈতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা সাংবাদিককে মেনে চলতে হয়:
- মানহানি (Defamation): কোনো ব্যক্তির সুনাম বা মর্যাদাহানি হয় এমন মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা আইনত দণ্ডনীয়।
- আদালতের অবমাননা (Contempt of Court): বিচার প্রক্রিয়া বা আদালতের মর্যাদাহানি হয় এমন কোনো সংবাদ পরিবেশন করা।
- রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা (National Security): রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা বা জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে এমন তথ্য প্রকাশ করা।
- গোপনীয়তা (Privacy): কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা ব্যক্তিগত তথ্য অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা।
খ. সাংবাদিকতার নৈতিক মূল্যবোধ ও আচরণবিধি
আইনি বাধ্যবাধকতার বাইরেও সাংবাদিকতার নিজস্ব কিছু নৈতিক মূল্যবোধ ও আচরণবিধি রয়েছে, যা সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা করে।
- সত্যবাদিতা (Truthfulness): প্রতিটি তথ্য নির্ভুল এবং সত্য হওয়া উচিত। কোনো রকম বিকৃতি ছাড়া তথ্য উপস্থাপন করা।
- নিরপেক্ষতা (Objectivity): ব্যক্তিগত মতামত, বিশ্বাস বা পক্ষপাতিত্ব সংবাদের উপর যেন প্রভাব না ফেলে।
- জবাবদিহিতা (Accountability): প্রকাশিত সংবাদের জন্য দায়বদ্ধ থাকা এবং ভুল হলে দ্রুত সংশোধন করা।
- দায়িত্বশীলতা (Responsibility): সংবাদের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সমাজের ক্ষতি এড়িয়ে চলা।
- জনস্বার্থ (Public Interest): সব সময় জনগণের বৃহত্তর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
- গোপনীয়তা ও সম্মান (Privacy and Respect): ব্যক্তিজীবনের গোপনীয়তাকে সম্মান করা এবং মানুষের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করা।
- স্বচ্ছতা (Transparency): তথ্যের উৎস এবং তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি সম্পর্কে পাঠকের কাছে স্বচ্ছ থাকা।
গ. তথ্য প্রকাশে সততা, গোপনীয়তা ও দায়িত্ব
- সততা: তথ্যের নির্ভুলতা এবং পরিবেশনে সততা বজায় রাখা। কোনো প্রলোভন বা চাপের মুখে সত্যকে বিকৃত না করা।
- গোপনীয়তা: তথ্যের সূত্রের পরিচয় গোপন রাখা সাংবাদিকদের একটি পবিত্র দায়িত্ব। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কেবল সূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা করলেই পাওয়া যায়। তবে, যদি কোনো সূত্রের তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তবে সেই দায়বদ্ধতা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
- দায়িত্ব: প্রকাশিত তথ্যের ব্যাপক সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা। বিশেষ করে সংবেদনশীল বিষয়, যেমন - জাতিগত সংঘাত, অপরাধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংবাদ পরিবেশনে দায়িত্বশীলতা বজায় রাখা।
৩. মানহানি ও তথ্য অধিকার আইন
মানহানি আইন সাংবাদিকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি সীমাবদ্ধতা, অন্যদিকে তথ্য অধিকার আইন তাদের তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ বাড়ায়।
ক. মানহানির সংজ্ঞা, উদাহরণ, ও বাংলাদেশের প্রচলিত আইন
- মানহানির সংজ্ঞা: মানহানি হলো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম বা মর্যাদাহানি করে এমন মিথ্যা বক্তব্য বা তথ্য প্রকাশ করা। এটি লিখিত হলে 'লিবেল' (Libel) এবং মৌখিক হলে 'স্ল্যান্ডার' (Slander) নামে পরিচিত। মানহানির ক্ষেত্রে সত্য প্রমাণ করার দায়ভার প্রায়শই প্রকাশকের (সাংবাদিক/সংবাদমাধ্যম) উপর বর্তায়।
- সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে উদাহরণ:
- কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রকাশ করা, যা তার সামাজিক বা পেশাগত অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে ভুল তথ্য দিয়ে পণ্য বা সেবার মান সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করা, যা কোম্পানির ব্যবসায়িক ক্ষতি করে।
- ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করে এমন মিথ্যা তথ্য বা গুজব প্রকাশ করা।
- বাংলাদেশের প্রচলিত আইন: বাংলাদেশে মানহানির বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির (Penal Code) ৪৯৯ ও ৫০০ ধারায় বিধান রয়েছে। এছাড়া, ডিজিটাল মাধ্যমে মানহানির জন্য 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮' (Digital Security Act 2018)-এর ২৫, ২৯ এবং ৩১ ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে, যা সাংবাদিকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত বিষয়। এই আইনের প্রয়োগে প্রায়শই সাংবাদিকদের হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ ওঠে।
খ. ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন (Right to Information Act): সাংবাদিকদের জন্য এর প্রয়োগ
- আইনের সংজ্ঞা: ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন (Right to Information Act 2009) বাংলাদেশের নাগরিকদের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল তথ্য জানার অধিকার প্রদান করে। এই আইনটি সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত হয়েছে।
- সাংবাদিকদের জন্য প্রয়োগ: এই আইনটি সাংবাদিকদের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এর মাধ্যমে সাংবাদিকরা সরকারি দপ্তরের নথি, বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, বাজেট সংক্রান্ত তথ্য এবং অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য সহজে পেতে পারেন, যা তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে সহায়তা করে।
- গুরুত্ব: এই আইনটি তথ্য প্রবাহকে অবাধ করে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাংবাদিকদের ভূমিকা বাড়ায়।
গ. তথ্য না পাওয়ার আইনি প্রতিকার
যদি কোনো সাংবাদিক তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তথ্য চেয়ে আবেদন করেন এবং তথ্য প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ তথ্য দিতে অস্বীকার করে বা আংশিক তথ্য দেয়, তবে তার জন্য আইনি প্রতিকারের সুযোগ রয়েছে:
- আপিল: প্রথমে তথ্য প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে আপিল করা যায়।
- তথ্য কমিশনে অভিযোগ: আপিলে সন্তুষ্ট না হলে বা আপিলের কোনো উত্তর না পেলে, তথ্য কমিশনে (Information Commission) অভিযোগ দায়ের করা যায়। তথ্য কমিশন অভিযোগের ভিত্তিতে শুনানির আয়োজন করে এবং প্রয়োজনে তথ্য সরবরাহের নির্দেশ দিতে পারে।
- জরিমানা: যদি প্রমাণিত হয় যে তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য দিতে অস্বীকার করেছেন, তবে তথ্য কমিশন তার বিরুদ্ধে জরিমানাসহ অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।
৪. প্রকাশনা ও সম্প্রচার নীতিমালা
সংবাদমাধ্যম পরিচালনার জন্য প্রতিটি দেশে নির্দিষ্ট নীতিমালা ও আইন থাকে, যা কন্টেন্ট পরিবেশন, লাইসেন্সিং এবং নৈতিকতা নিয়ন্ত্রণ করে।
ক. বাংলাদেশে প্রচলিত ইলেকট্রনিক মিডিয়া নীতিমালা
বাংলাদেশে টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলগুলো পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। এই নীতিমালাগুলো কন্টেন্ট, বিজ্ঞাপন, সম্প্রচারের সময় এবং লাইসেন্সিং সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
- সম্প্রচার আইন (প্রস্তাবিত): যদিও একটি পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচার আইন এখনো পাস হয়নি, তবে বিভিন্ন সময়ে খসড়া নীতিমালা তৈরি হয়েছে, যা সম্প্রচার মাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করে।
- সেন্সরশিপ: নির্দিষ্ট কিছু বিষয়বস্তু (যেমন - রাষ্ট্রবিরোধী, ধর্মীয় উসকানি, অশ্লীলতা) সম্প্রচার করা নিষিদ্ধ।
- লাইসেন্সিং: যেকোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া পরিচালনার জন্য সরকারি অনুমোদন বা লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক।
খ. অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য প্রযোজ্য নীতিমালা
অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং সামাজিক মাধ্যমগুলো তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও, এদের জন্যও বিভিন্ন নীতিমালা এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি হচ্ছে।
- নিউজ পোর্টাল নিবন্ধন নীতিমালা: বাংলাদেশে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো অননুমোদিত এবং গুজব সৃষ্টিকারী পোর্টালগুলো নিয়ন্ত্রণ করা।
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮: এই আইনটি অনলাইনে প্রকাশিত তথ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এর আওতায় ভুয়া তথ্য, মানহানি, সাম্প্রদায়িক উসকানি, এবং রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে, এর প্রয়োগ নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।
- সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার নীতিমালা: যদিও সরাসরি সংবাদমাধ্যমের জন্য নয়, তবে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত বা পেশাগত সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কিছু অলিখিত নৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং আইনি ঝুঁকি (বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায়) থেকে যায়।
গ. প্রেস কাউন্সিলের ভূমিকা
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন ও নৈতিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সংজ্ঞা: প্রেস কাউন্সিল একটি আধা-বিচারিক (quasi-judicial) সংস্থা, যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা, সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন এবং সাংবাদিকদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য গঠিত হয়েছে।
- ভূমিকা:
- সাংবাদিকদের জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
- সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগের শুনানি ও নিষ্পত্তি।
- সাংবাদিকতার মানোন্নয়নের জন্য সুপারিশ প্রদান।
- সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করা।
- সীমাবদ্ধতা: প্রেস কাউন্সিলের ক্ষমতা মূলত সুপারিশমূলক এবং এর সিদ্ধান্তগুলো আইনত বাধ্যবাধকতামূলক নয়, যা এর কার্যকারিতাকে অনেক সময় সীমিত করে।
৫. সংবাদ যাচাইকরণ এবং ভুল তথ্য প্রতিরোধ
ডিজিটাল যুগে ভুল তথ্য এবং গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। সাংবাদিকদের জন্য সংবাদ যাচাইকরণ এবং ভুল তথ্য প্রতিরোধ করা একটি মৌলিক দায়িত্ব।
ক. ভুয়া খবর ও গুজবের কারণে সামাজিক ক্ষতি
- জনগণের বিভ্রান্তি: ভুয়া খবর জনগণকে ভুল তথ্য দেয়, যা তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেয়।
- আস্থার সংকট: সংবাদমাধ্যম যখন বারবার ভুল তথ্য প্রকাশ করে, তখন জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।
- সামাজিক অস্থিরতা: মিথ্যা খবর বা গুজব সমাজে বিভেদ, ঘৃণা এবং এমনকি সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে।
- রাজনৈতিক মেরুকরণ: ভুয়া খবর প্রায়শই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়, যা সমাজে মেরুকরণ বাড়ায় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- স্বাস্থ্য ঝুঁকি: জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত ভুয়া খবর মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে (যেমন, ভুল স্বাস্থ্য উপদেশ)।
খ. Fact-checking টুল ও কৌশল
সাংবাদিকদের ভুয়া খবর প্রতিরোধে বিভিন্ন ফ্যাক্ট-চেকিং টুল ও কৌশল ব্যবহার করা উচিত।
- একাধিক উৎস থেকে যাচাই: একটি তথ্যের সত্যতা অন্তত দুটি স্বাধীন ও নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে নিশ্চিত করুন।
- প্রাথমিক উৎসের সন্ধান: ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, সরকারি নথি বা সংশ্লিষ্টদের সরাসরি বক্তব্যকে অগ্রাধিকার দিন।
- রিভার্স ইমেজ সার্চ: ছবির সত্যতা যাচাই করতে (এটি কি আসল ছবি বা অন্য কোনো ঘটনার ছবি?) Google Images, TinEye এর মতো টুল ব্যবহার করুন।
- ভিডিও যাচাই: ভিডিওর উৎস, সময় এবং এর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করুন।
- ডেটা বিশ্লেষণ: পরিসংখ্যান বা ডেটার উৎস এবং বিশ্লেষণ পদ্ধতি যাচাই করুন।
- বিশেষজ্ঞের মতামত: বিতর্কিত বা জটিল বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত নিন।
- সামাজিক মাধ্যম পর্যবেক্ষণ: সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া গুজবের দিকে নজর রাখুন এবং সতর্কতামূলক বার্তা দিন।
গ. সাংবাদিকদের দায়িত্ব: তথ্য যাচাই, উৎস যাচাই
সংবাদ যাচাইকরণ কেবল একটি কৌশল নয়, এটি সাংবাদিকদের একটি মৌলিক দায়িত্ব।
- প্রতিটি তথ্যের জন্য দায়বদ্ধতা: প্রকাশিত প্রতিটি শব্দ, ছবি বা ভিডিওর জন্য সাংবাদিক দায়বদ্ধ।
- উৎসের বিশ্বাসযোগ্যতা: তথ্যের উৎসের বিশ্বাসযোগ্যতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করুন। অজ্ঞাত সূত্রের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন।
- ভুল হলে সংশোধন: যদি কোনো ভুল তথ্য প্রকাশিত হয়, তবে দ্রুততম সময়ে তা স্বীকার করে সুস্পষ্টভাবে সংশোধন করুন।
- স্বচ্ছতা: সংবাদ যাচাইয়ের প্রক্রিয়া এবং তথ্যের উৎস সম্পর্কে পাঠককে অবগত রাখুন, যা পাঠকের আস্থা বাড়াবে।
৬. উপসংহার: নৈতিক ও আইনি চর্চা সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিরাপদ করে
সাংবাদিকতা পেশার ভিত্তি হলো বিশ্বাসযোগ্যতা এবং জনআস্থা। এই ভিত্তি মজবুত রাখার জন্য সাংবাদিক আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান এবং এর বাস্তব প্রয়োগ অপরিহার্য। আইনি সীমাবদ্ধতাগুলো যেখানে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার সীমা নির্দেশ করে, সেখানে নৈতিক নীতিমালাগুলো পেশাগত আচরণ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে, স্বাধীন ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার কোনো বিকল্প নেই। সাংবাদিককে অবশ্যই আইন ও নৈতিকতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ভুয়া খবর, গুজব এবং প্রপাগান্ডার এই যুগে, সাংবাদিকদের জন্য তথ্যের সত্যতা যাচাই এবং নির্ভুল সংবাদ পরিবেশন করা একটি মহৎ দায়িত্ব। যখন সাংবাদিকরা নৈতিক ও আইনি চর্চায় নিষ্ঠাবান থাকেন, তখন তারা কেবল তাদের পেশাগত স্বাধীনতা রক্ষা করেন না, বরং একটি সচেতন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আইন ও নীতিমালার সঠিক চর্চাই সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎকে নিরাপদ ও উজ্জ্বল করে তোলে।